” “

Friday 26 June 2020

হৃদয়বান ব্যক্তিত্ব অভিনেতা দিলীপ রায়


সময়টা ১৯৯৪ নাগাদ। রংমহলে ‘মানিকচাঁদ’ নাটক চলছে।
তারিখ মনে নেই, একটা ম্যাটিনি শোয়ের আগে খবর এল সরযূদেবী (সরযূ মা) প্রয়াত হোয়েছেন।

দিলীপদা (অভিনেতা দিলীপ রায়), জ্ঞানেশদা (অভিনেতা জ্ঞানেশ মুখার্জী) আলোচনা করলেন, "আজ দু’টো শোই বন্ধ থাকবে"(আমি শ্রোতা)।

নায়ক তাপস পালকে জিজ্ঞেস করা হোল-
ও বলল যে আপনারা যা বলবেন-তাই হবে-
টিকিটের দাম ফেরত হোল ওই দিনের।
ওই দিন শো বন্ধ থাকল।

বিকেল চারটা নাগাদ প্রযোজক এসে গ্রিনরুমে খানিকটা উত্তেজিত হোয়ে কৈফিয়ত চাইলেন ওনাকে না জানিয়ে শো বন্ধ করার জন্য—
প্রেক্ষাগৃহ সংলগ্ন ওনার অফিসে একটু আলোচনার জন্য বসার অনুরোধ করলেন।

দিলীপদা আমাকে নিয়ে অফিসে ঢুকলেন।
কিন্তু প্রযোজক মুখার্জিবাবুর এক ক্ষোভ-
দিলীপদা স্থির গলায় বললেন, "আপনি অভিনেত্রী সরযূদেবীর নাম শুনেছেন?
না শোনারই কথা---মদের কারবারি আপনি-
যাক--আপনি প্রযোজক যখন--আমি এক মাসের নোটিশ দিলাম--আর এখানে অভিনয় করবনা"।

কিন্তু দিলীপদা কাউকেই বিন্দুমাত্র প্ররোচিত করেন নি।

ঐ চরিত্রের জন্য অরুণ ব্যানার্জি এলেন।
মানিকচাঁদ নাটক চলল।

শিখলাম--বড় হোতে গেলে যেমন অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোতে হয়
আবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া সোজা রাখতে হয়।

-নৃপেন সমাদ্দার




"শ্রীমান শ্রীমতি" নাটকের একশ রজনীর
উৎসব। সরযূদেবীর হাত থেকে স্মারক
উপহার নিচ্ছেন অভিনেতা নৃপেন সমাদ্দার।
সময়টা ১৯৮২ নাগাদ।




নিচে নেট থেকে খুঁজেপেতে সংগ্রহ করে সরযূবালা দেবীর জীবনী ব্লগের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হল। রচয়িতা: ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

সখের থিয়েটারে ভিক্ষুক বালকের অভিনয় থেকে নাট্যসম্রাজ্ঞী - সরযূবালা

গিরিশ যুগ থেকে শিশির যুগ পর্যন্ত তারাসুন্দরীতিনকড়িকুসুমকুমারীকঙ্কাবতীপ্রভা দেবী প্রমুখ বহু প্রতীভাময়ী অভিনেত্রী সাধারণ রঙ্গালয়কে সমৃদ্ধ করেছেন অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি প্রয়াত হলেন ১৯০৯- তিন বছর পরে ১৯১২-তে গিরিশচন্দ্রও চলে গেলেন। অমরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রয়াত হলেন ১৯১৬-তে অর্ধেন্দুশেখরগিরিশচন্দ্র ও অমেরেন্দ্রনাথ দত্তর মত সৃজনশীল অভিনেতা-পরিচালকের প্রয়াণে ব্যবসায়িক থিয়েটারে বড় শূন্যতা এলোথিয়েটারের সংগঠনেও নানান বিশৃঙ্খলা ও দুর্বলতা প্রকট হল ১০২০-র দশকে বাংলা থিয়েটার পেয়েছিল এক অসামান্য অভিনেতাকে তিনি নির্মলেন্দু লাহিড়ীব্যক্তি জীবনে যিনি ছিলেন নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভাগিনেয় প্রায় একই সময়ে বাংলা থিয়েটার পেল নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীকে বাংলা মঞ্চে তখন গিরিশ পুত্র দানিবাবুনির্মলেন্দু লাহিড়ী ও শিশিরকুমারের সৃজনশীলতা ১৯২৭ - নির্মলেন্দু লাহিড়ীর তখন কোন বাঁধা মঞ্চ নেই ভ্রাম্যমান থিয়েটার দল নিয়ে বাংলার মফঃস্বলে নাট্যাভিনয় করেন নতুন নাটক ধরবেন নির্মলেন্দু, কিন্তু নায়িকা নির্বাচ করতে পারছেন না তাঁর দলের প্রখ্যাত অভিনেত্রী তারাসুন্দরীকুসুমকুমারীআশ্চর্যময়ীরা বয়সের ভারে ক্লান্ত নতুন মুখের সন্ধান করছেন নির্মলেন্দু এই সময় নির্মলেন্দু সন্ধান পেলেন এক ষোড়সী কিশোরীর দক্ষিণেশ্বর অঞ্চলের শখের থিয়েটার এমিনেন্ট থিয়েটারে অভিনয় করে নির্মলেন্দু এমিনেন্ট থিয়েটারে সেই কিশোরীর অভিনয় দেখতে গেলেন চন্দ্রশেখর’ নাটকে শৈবলিনীর চরিত্রে অভিনয় করছিলেন সেই কিশোরী নাম তার সরযূবালা কিশোরীর অভিনয়ে মুগ্ধ নির্মলেন্দু তাকে তাঁর ভ্রাম্যমান নাট্যদলে যোগ দিতে বললেন চন্দ্রশেখরচন্দ্রগুপ্ত, বঙ্গেবর্গীপ্রফুল্লদেবলাদেবীশ্রীদুর্গা ও ষোড়শী এই সাতটি নাটক নিয়ে ভ্রাম্যমান নাট্যদল পূর্ব বাংলা ও বার্মা সফরে গেলেন নির্মলেন্দু আর প্রতিটি নাটকেই প্রধান স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করলেন সরযূবালা
    জন্ম ১৯১২দক্ষিণেশ্বরের এক দরিদ্র পরিবারে পিতা ভূতনাথ দত্ত সরযূর নিতান্ত শৈশবেই প্রয়াত হন দারিদ্রের কারণে স্কুলশিক্ষা অর্জন করতে পারেননি সুরূপা ছিলেন না মোটেইছিলেন কিছুটা খর্বাকৃতির কিন্তু কন্ঠস্বর ছিল তাঁর ঐশ্বর্য নয় বছর বয়সে এমিনেন্ট থিয়েটারে কুমার সিংহ’ নাটকে এক ভিক্ষুক বালকের চরিত্রে সরযূর প্রথম মঞ্চাভিনয় কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনয়ের আগেই সরযূ শখের থিয়েটারে বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করেন তাঁর অভিনয় প্রতিভা পরিণত হল নির্মেলেন্দু লাহিড়ীর নাট্যশিক্ষায়
    কলকাতায় ফিরে নির্মলেন্দু সরযূবালাকে নিয়ে এলেন মনমোহন থিয়েটারে গিরিশচন্দ্রের পুত্র দানীবাবু ছিলেন মনমোহনের ম্যানেজার এখানেই দানীবাবুর পরিচালনায় মীরাবাঈ’ নাটকে প্রথম পেশাদারী রঙ্গালয়ে অভিনয় করলেন এখানে কিশোরী সরযূর সহ অভিনেত্রী ছিলেন প্রবাদ-প্রতীম তারাসুন্দরী ও কুসুমকুমারী ব্যবসায়িক থিয়েটারে তখন নানান বিশৃঙ্খলা নতুন নাটকের অভাব মনমোহন থিয়েটারে সরযূবালায় মুগ্ধ দানীবাবু পুরাতন নাটক নামাচ্ছেন বিষবৃক্ষ’ নাটকে গুরুত্বপূর্ণ কুন্দনন্দিনীর ভুমিকা পেলেন সরযূ এরপর দক্ষযজ্ঞনাটকে সরযূ সতী ও দানীবাবু মহাদেব একদা যে চরিত্র দুটি অভিনয় করতেন বিনোদিনী ও গিরিশচন্দ্র দানীবাবু তখন প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায় আর সরযূ সতেরো বছরের কিশোরী দর্শক সে নাটক নেয়নি কিন্তু প্রসংশিত হয়েছিল সরযূর অভিনয়
    থিয়েটার থেকে সাময়িক সরে গিয়ে তখনকার নতুন বিনোদন সিনেমাতেও অভিনয় করেছিলেন সরযূবালা ১৯৩১-এ নির্বাক ছায়াছবি ঋষির প্রেম’-এ প্রথম অভিনয় এই নির্বাক চিত্রে নায়িকা ছিলেন কাননদেবী ১৯৩৫-এ পায়ের ধুলো’ ছবিতে অভিনয় করার পর আর সিনেমা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিজের চেহারা সম্পর্কে তাঁর একটা হীনমন্যতা ছিল কিন্তু প্রমথেশ বড়ুয়ার পিড়াপিড়িতে তাঁর সঙ্গে শাপমুক্তি’, ‘মায়ের প্রাণ’ সহ আরো কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন কিন্তু সিনেমা সরযূর যায়গা ছিল না। সিনেমাকে তিনি ভালোবাসতে পারেননিফিরে গিয়েছিলেন থিয়েটারে
    বিপুল বিস্তৃতি ছিল সরযূর নাট্যজীবনের ১৯২২-এ নবছর বয়স থেকে ১৯৭৮-এ ৬৬ বছর পর্যন্ত মঞ্চাভিনয় করেছেন গিরিশ যুগের শেষ প্রতিনিধি দানীবাবুনির্মলেন্দু লাহিড়ীশিশিরকুমার ভাদুড়ী থেকে আধুনিক অভিনয় ধারার নাট্যশিল্পী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সাবিত্রি চট্টোপাধ্যাএর সঙ্গেও অভিনয় করেছেন ঐতিহাসিকপৌরাণিকসামাজিককৌতুক নাটক সব ধরণে নাটকেই অভিনয় করেছেন সরযূ গিরিশ যুগশিশির যুগ এবং ১৯৫০ পরবর্তী আধুনিক অভিনয় ধারা নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন তাই তিনি নাট্যসম্রাজ্ঞী
    কেমন ছিল নাট্যসম্রাজ্ঞীর অভিনয় তা জানতে স্বভাবতই আমাকে নির্ভর করতে হবে নাট্য ঐতিহাসিক, আলোচকদের বয়ানের ওপর তরুণ বয়সে নাট্যসম্রাজ্ঞীর দুতিনটি নাট্যাভিনয় দেখার সুযোগ পেয়েছি, শুনেছি তাঁর রেডিও নাটক, যার কিছু স্মৃতি মাত্র আছে আমার স্মৃতিতে এখনো উজ্বল গ্রামফোন রেকর্ডে শোনা শাহজাহান’ নাটকে জাহানারাও শিরাজদৌল্লা নাটকে লুৎফা’ চরিত্রের অভিনয় নাট্য ঐতিহাসিক ও আলোচকরা বলেন জাহানারা’ চরিত্রের অভিনয়ই নাট্যসম্রাজ্ঞীর শ্রেষ্ঠ অভিনয়কীর্তি নাট্য ঐতিহাসিক অধ্যাপক অজিতকুমার ঘোষ শিশির যুগের অভিনয় ধারার বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে লিখেছেন, এ কথা অস্বীকার করা যায় না যেঅভিনেত্রীর কাম্য কতকগুলি সম্পদ থেকে সরযূদেবী বঞ্চিত তাঁর আকৃতি দীর্ঘ নয় এবং চেহারাতেও কোন অসামান্য আকর্ষণ নেই কিন্তু এসব সম্পদ না থাকা সত্বেও সযত্ন চেষ্টা ও অনুশীলনের দ্বারা তিনি তাঁর অভিনয়কে অসাধারণ স্তরে উন্নীত করতে পেরেছেন তিনি যখন তাঁর দেহভঙ্গিকে ঋজুকঠিন ও প্রত্যয়শীল করে তোলেন তখন তাঁর আকৃতির খর্বতা আর চোখে পড়ে না স্বরের মধ্যে বৈচিত্র্য আনতে স্বরপ্রক্ষেপ করতে তিনি বিশেষ পারদর্শিনী শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর লক্ষণ প্রকাশ পায় বিচিত্র রসের অভিনয় ক্ষমতার মধ্যে” (রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী/অমিত মৈত্র) তাঁর কন্ঠস্বরে দৃঢ়তার প্রকাশ, নিখুঁত উচ্চারণ ও অসামান্য স্বরপ্রক্ষেপন কৌশল সমস্ত শারীরিক ত্রুটি ঢেকে দিত শুধু ঐতিহাসিক বা সামাজিক নাটকের ব্যক্তিত্বময়ী অভিনয়ই বা কেন আমার স্মৃতিতে আছে ১৯৭৮ সালে জয়মা কালী বোর্ডিং’-এ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পূর্ববাংলার বাকভঙ্গিমায় অসাধারণ অভিনয় এই নাটকই ছিল নাট্যসম্রাজ্ঞীর ছাপ্পান্ন বছরের নাট্যজীবনের শেষ অভিনয় দীর্ঘ ছাপান্ন বছরের অভিনয় জীবনে নাট্যসম্রাজ্ঞী অভিনয় করেন আশিটি নাটকে শেষ অভিনয় ১৯৭৯-তে রঙ্গনা মঞ্চে জয়মা কালী বোর্ডিং’ নাটকে
    সুদীর্ঘ অভিনয় জীবনে সরযূবালা আশিটি নাটকে সুনামের সঙ্গে অভিনয় করেছেন কয়েকটি নাটকে তাঁর অভিনয় বাংলার থিয়েটারপ্রেমিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়ে আছে সেগুলি হল ১৯২৯-এ মন্মথ রায় রচিত মহূয়ানাটকের নাম ভুমিকায়, ১৯৩০-এ মন্মথ রায়ের কারাগারনাটকে কঙ্কা’ ও শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের গৈরিক পতাকা’, ১৯৩৫-এ মন্মথ রায় রচিত খনা’ নাটকে নাম ভুমিকায়, ১৯৩৬-এ শচীন্দ্রলাল সেনগুপ্তের শিরাজদৌল্লা নাটকে লুৎফা’ ১৯৩৯-এ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের শাহজাহান’ নাটকে জাহানারা’, ১৯৪৩-এ 'দেবদাস' নাটকে পার্বতী’ 'ধাত্রী পান্না' নাটকে পান্না’, ১৯৫৩-তে 'শ্যামলী' নাটকে সরলা
    ‘মহুয়া’ মন্মথ রায় লিখেছিলেন ময়মন সিংহ গীতিকার কাহিনী নিয়ে নাচ-গানে জমাটি প্রেমের নাটক ব্যবসায়িক থিয়েটারে সেই প্রথম লোকনাট্য নিয়ে এসেছিলেন মন্মথ রায় নাচগান অভিনয়ে সরযূর বহুমুখী প্রতিভার প্রকাশ হয়েছিল এ নাটকে মহুয়ার সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম সেই সুবাদে নজরুলের কাছে সঙ্গীত শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন 'নাচঘর' পত্রিকার আলোচক লিখেছিলেন এই নবীনা নটীর শক্তি আমাদের বিস্মিত করেছে এতটুকু দেহের ভিতরে এমন ভাব প্রকাশের শক্তি যে গোপন থাকতে পারেনা দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত” (‘রঙ্গালয়ে বঙ্গ নটী’/অমিত মৈত্র)  
    ১৯৩০-এর দশকটা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অগ্নিসময় সেই সময়ের দুটি নাটক সরযূর অভিনয় জীবনে তো বটেই, বাংলার পেশাদারী থিয়েটারেরও স্মরণীয় প্রযোজনা শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর গৈরিক পতাকা’ ও মন্মথ রায়ের কারাগার’ সেদিন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে শক্তি যুগিয়েছিল ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পরে সেই সময়ের প্রসিদ্ধ রূপমঞ্চ’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে সরযূ বলেছিলেন মনে হতনা  যে আমি থিয়েটার করছি মনে হত – স্বাধীনতা যুদ্ধে নেমেছি” (‘রঙ্গালয়ে বঙ্গ নটী’/অমিত মৈত্র) মনমোহন থিয়েটারের জন্য শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত মারাঠাবীর শিবাজীর জীবনী ও দেশপ্রেম নিয়ে লেখা নাটকটিতে প্রধান চরিত্রে ওভিনয় করেছিলেন নির্মলেন্দু লাহিড়ী ও সরযূবালা ঐ বছরেই পেশাদারী মঞ্চের আর একটি নাটক আলোড়ন তুলেছিল সেটি মন্মথ রায়ের রচনা কারাগার পৌরাণিক কাহিনীর রূপকে দেশাত্মবোধ জাগানোর নাটক ছিল কারাগার নাট্যকার মন্মথ রায়ের বয়ানে দেশে তখন রাজশক্তির বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলন চলছিল দলে দলে লোক কারাবরণ করছিল মহাত্মাজীর নির্দেশও ছিল তাই এই পটভূমিকায় মহাভারতে বর্ণিত কংশ-কারাগারের কথা আমার মনে এসেছিল। যে কারাগারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল সেই কারাগারেই আজ উদিত হবে আমাদের জাতীয় জীবনের স্বাধীনতা সূর্য চল সব সেই মহাতীর্থে – এই ভাব থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল আমার এই কারাগার’ নাটক” (‘কারাগার ও নাট্যকার মন্মথ রায়’/ ধীরেন্দ্র দেবনাথ – নাট্য আকাদেমি পত্রিকা ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭) নাটকটির সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম মাসখানেকের  মধ্যেই নাটকটির বিরুদ্ধে রাজরোষ নেমে এসেছিল রাজদ্রোহের অভিযোগে কারাগারের অভিনয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো ইংরাজ সরকার, চুয়ান্ন বছর আগেকার নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারার জোরে কারাগার’ নাটক সেই সময় কী প্রবল উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল করেছিল তার বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায় নাট্যসম্রাজ্ঞীর লেখায় “... ‘কারাগার’ অভিনয় হবে... এটা আমাদের কাছে তখন আর অভিনয় নয়রীতিমত মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম মনমোহন থিয়েটার ছিল সেন্ট্রাল এভিনিউতে প্রথম অভিনয় রজনীতে লোকজন ভেঙে পড়েছে। সে কী উন্মাদনা! মূল দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে আমরা মাঝে মাঝে পর্দার ফাঁক দিয়ে ভিড়ের সেই চেহারা দেখে আরো অনুপ্রাণিত হয়ে উঠছি অভিনয় হল সে কী আনন্দ আমাদের! ... অভিনয়ের মধ্যেই জনারণ্য থেকে স্লোগান উঠছে – ‘বন্দে মাতরম তখন অল্প বয়স আমাদের এই জাগরণ দেখে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছি তখন আমরা আর কেউ অভিনেতা অভিনেত্রী নই, প্রত্যেকেই স্বাধীনতা সৈনিক” (নাট্যকার মন্মথ রায়ের জীবনী ও নাট্য সাধনা/অতুলচন্দ্র চক্রবর্তী – প.ব.নাট্য আকাডেমি পত্রিকা ফেব্রুয়ারি ৯৭ সংখ্যায় উদ্ধৃত)
    নাট্যকার মন্মথ রায় সরযূর নাচ, গান,অভিনয়ের বহুমুখী দক্ষতাকে মনে রেখে মহুয়া’ লিখেছিলেন তেমনই তাঁর অভিনয় ক্ষমতাকে মনে রেখে নায়িকা প্রধান ঐতিহাসিক নাটক খনা’ মঞ্চস্থ হল ১৯৩৫-এর জুলাই মাসে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় নির্মলেন্দু লাহিড়ী-সরযূবালা জুটি তখন প্রবল জনপ্রিয় অনেকদিন ধরে চলেছিল খনা নাট্য ঐতিহাসিক অজিতকুমার ঘোষ খনা’ নাটকে সরযূর অভিনয় সম্পর্কে লিখেছিলেন তাঁর করুণ রসাত্মক অভিনয়ের বৈশিষ্ট্য হল দ্রুত কন্ঠস্বরের পরিবর্তন করে হঠাৎ একটা ক্কূলহারা আর্তনাদের তাঁর কথাগুলি যেন ভেঙে পড়ে প্রবলভাবে নিঃশ্বাসবায়ু আকর্ষণের মধ্যেও একটা বুকফাটা বেদনার হাহাকার যেন ছড়িয়ে পড়ে
    ব্যবসায়িক থিয়েটারে তখন ক্ষয়ের কাল শুরু হয়েছে শিশিরকুমার ভাদুড়ী নতুন নাটক ধরতে পারছেন না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছেঅন্যদিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতা এই আবহেও নির্মলেন্দু লাহিড়ী-সরযূবালা জুটির নাটক মঞ্চসাফল্য পাচ্ছে মহুয়াগৈরিক পতাকাকারাগারখনা প্রভৃতি নাটকে অবিস্মরণিয় অভিনয় করে সরযূ তখন খ্যাতির শিখরে ১৯৩৮-এ মিনার্ভা নতুন নাটক ধরলো শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর সিরাজদৌল্লা নির্মলেন্দু লাহিড়ী সিরাজ, সরযূবালা লুৎফা বাংলা রঙ্গালয়ের ইতিহাসে সিরাজ-উদ-দৌলা ছিল এক যুগান্তকারী প্রযোজনা এক সময় এ নাটকের সংলাপ প্রবাদের মত লোকের মুখে মুখে শোনা যেত বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটাজাতীর সৌভাগ্যসূর্য আজ অস্তাচলগামী কে তাকে দেবে আশা ...। দেশাত্মবোধের জাগরণ ও জাতীয় ঐক্যের বার্তা সঞ্চার ছিল এ নাটকের উদ্দেশ্য সিরাজদৌল্লা কী প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল তার একটি বর্ণনা পাই নাট্যসম্রাজ্ঞীর স্মৃতিচারণে নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত শতবার্ষিকী স্মরণিকায় লিখেছিলেন “... সিরাজদ্দৌলার অভিনয় হচ্ছে হঠাৎ শুনলাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র ও হেমেন্দ্রকুমার রায় এসেছেন নাটক দেখতে আমি মঞ্চের উপর লুৎফার অভিনয় করছি লুৎফার সংলাপে ছিল চলুন জাহাঁপনা আপনার হাত ধরে এই আঁধার রাতে আমরা বেরিয়ে পড়ি কেউ জানবে না, বাংলার নবাব তাঁর বেগমের হাত ধরে চিরদিনের মতো বাংলা ছেড়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ... হঠাৎই সামনের সারিতে নজর পড়লোসুভাষচন্দ্র রুমাল বার করে চোখ মুছলেন অভিনয় শেষে তিনি ভিতরে এসে শচীনদাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন নেতাজী আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন আমরা অভিভুত হয়ে দুই মহান মানুষকে আলিঙ্গনাবদ্ধ দেখলাম (শচীন্দ্রনাথ ও সিরাজদ্দৌলা’/দীপেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত – নাট্য আকাডেমি পত্রিকাফেব্রুয়ারি ৯৭)
    সিরাজদ্দৌলার পরে যে নাট্য চরিত্রটি সরযুকে লিজেন্ড’ করেছিল সেটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের শাহজাহান নাটকের জাহানারা প্রথমে শিশিরকুমার ভাদুড়ী করতেন শাজাহানঔরঙ্গজেব দানীবাবু পরে নির্মলেন্দু লাহিড়ীও করেছেন তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে পেশাদারী মঞ্চে নানান দল শাহজাহান নাটকের অভিনয় করেছেন শিশিরকুমার ভাদুড়ী থেকে ছবি বিশ্বাস কত অভিনেতাই শাজাহান করেছেন কিন্তু জাহানারা চরিত্রে সরযূর কোন বিকল্প ছিল না তিনি নিজেই যে কতবার জাহানারার করেছেন নিজেই বিস্মৃত হয়েছিলেন অখন্ড বাংলার এমন কোন শহর নেই যেখানে তিনি জাহানারা চরিত্রে অভিনয় করেননি জাহানারা সরযূর সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্র সৃষ্টি বস্তুত জাহানারা চরিত্রে অসামান্য অভিনয়ের পর থেকেই তাঁর নামের সঙ্গে নাট্যসম্রাজ্ঞীর তকমা সংযোজিত হয়ে যায় আমাদের অশেষ সৌভাগ্য যে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানী বা ইনরেকো সিরাজদ্দৌলা’ ও শাহজাহান’ নাটকদুটি গ্রামফোন রেকর্ডে ধ্বনিবদ্ধ করে রেখেছিলেন সেই সুবাদে আমরা আজও গ্রামফোন রেকর্ড থেকে কমপ্যাক্ট ডিস্কে রূপান্তরিত অডিও নাটকে নাট্যসম্রাজ্ঞীর অসামান্য বাচিক অভিনয় শোনার সুযোগ পাই
    ১৯৩৯-এ শুরু হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ৪২-এ ভারতছাড়ো আন্দোলনে উত্তাল বাংলা৪৩-এ মানুষের সৃষ্টি মন্বন্তর – কলকাতার রাস্তায় মৃত্যুমিছিল কলকাতার থিয়েটার হল-এ দর্শকের আকালশিশিরকুমার নাটক করতে পারছেন না ব্যবসায়িক থিয়েটারে তখন চরম ক্ষয়ের সময় থিয়েটার হচ্ছে বটে কিন্তু দর্শক হচ্ছে না জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের অগ্নগর্ভ পরিস্থিতিবাংলার মন্বন্তর – এসব নিয়ে কোন হেলদোল ব্যবসায়িক থিয়েটারে ছিল না ইতিমধ্যে নতুনের আগমনের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছে ব্যবসায়িক থিয়েটার ১৯৪৩-এ গঠিত হয়েছে গণনাট্য সঙ্ঘ, মঞ্চে শ্রমজীবী মানুষের জীবন আর সংগ্রামের সামাজিক ভাবনার নাট্যভাষ্য তুলে ধরার আদর্শ নিয়ে শিশিরকুমারের মঞ্চেই বাংলা থিয়েটারের নবযুগের উন্মেষ ঘটলো শিশিরকুমারের শ্রীরঙ্গম মঞ্চে, ১৯৪৪-এর ১০ই জুলাই শম্ভু মিত্রর পরিচালনায় অভিনীত হল গণনাট্য সঙ্ঘের নাটক জবানবন্দীএবং ২৪শে অক্টোবর শম্ভু মিত্র ও বিজন ভট্টাচার্যের যৌথ পরিচালনায় অভিনীত হল সেই যুগান্তকারী নাটক নবান্ন বাংলা নাটকে নবযুগের উন্মেষে - নতুনতর নাট্যভাবনা থেকে দূরে থাকতে পারেননি ১৯৪৬-এ গণনাট্যকার তুলসী লাহিড়ী-র নাটক দুখীর ইমানপ্রযোজনা করার সাহস দেখিয়েছিলেন নবতর নাট্যভাবনা বাংলা থিয়েটারে তখন এসে গেছেন বিজন ভট্টাচার্যশম্ভূ মিত্র, উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটকরা পেশাদারী থিয়েটারের সেই ক্ষয়ের কালেও সরযুবালা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দী অভিনেত্রী
    ১৯৩৯-এ সাহজাহানের পর ১৯৫০ পর্যন্ত অনেকগুলি নাটকে অভিনয় করেছিলেন কিন্তু সেগুলিঐতিহাসিক নাটক, ‘ধাত্রী পান্না’ ও কিছুটা দেবদাস’ ছাড়া দর্শক আনুকুল্য পায়নি সামাজিক ভাবনার নাট্যধারার কাছে আবেগ সর্বস্ব মেলোড্রামাটিক’ অভিনয় ধারার সঙ্গে দর্শক আর মানিয়ে নিতে পারতেন না নতুন সময়ের সঙ্গে মানানসই চিন্তাধারার নাট্য সংগঠক ও পরিচালকও আর ছিলেন না। ১৯৫০-এর শুরুতে সরযূর নাট্যগুরু নির্মলেন্দু লাহিড়ী প্রয়াত হলেন সরযূ প্রায় তিনবছর থিয়েটার থেকে সরে থাকলেন ১৯৫৩-র অক্টোবরে স্টার থিয়েটারের আমূল সংস্কারের পর মঞ্চস্থ হল নিরূপমা দেবীর উপন্যাসের দেনারায়ণ গুপ্ত কৃত নাট্যরূপ শ্যামলী’ – এক বোবা মেয়ের দুর্ভাগ্যের নাট্যকথা নায়ক নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার ও সাবিত্রি চট্টোপাধ্যায় একনাগাড়ে ৪১৮ রাত্রি অভিনয়ের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল শ্যামলী স্নেহময়ী মা সরলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সরযূবালা শ্যামলীর স্টার থিয়েটারের পরের নাটক পরিণীতাতেও নাট্যসম্রাজ্ঞীকে দেখি মা ভুবনেশ্বরী চরিত্রে একাদিক্রমে তিন বছর ধরে দুটি নাটকে মা চরিত্রের সংবেদনশীল অভিনয়ের সূত্রে ব্যবসায়িক থিয়েটারে সকলের কাছে, দর্শকদের কাছেও হয়ে উঠলেন সরযূ মা এরপর তিনি দীর্ঘ সময় রঙমহল’ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন শুধু অভিনয়ই নয়থিয়েটারকে বাঁচানোর প্রয়াসেও সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন নাট্যসম্রাজ্ঞী ফেব্রুয়ারি ১৯৬২-তে রঙমহলের কর্মী, কলাকুশলীরা ধর্মঘট করেছিলেন তাদের নানা দাবী নিয়ে কর্তৃপক্ষ থিয়েটার বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন, পারেননি রঙমহল শিল্পীগোষ্ঠীরপরিচালনায় থিয়েটার সচল থাকলো, নেতৃত্রে ছিলেন জহর রায়ের সঙ্গে নাট্যসম্রাজ্ঞী ১৯৭৭ পর্যন্ত এই ভুমিকায় যুক্ত ছিলেন ১৯৬২ থেকে ১৯৭৭ রঙমহলের সঙ্গে যুক্ত থাকাকালীন এই পনেরো বছরে তাঁর অসামান্য অভিনয় রংমহলের প্রযোজনাগুলিকে সমৃদ্ধ করেছিল আর সেই সঙ্গে থিয়েটারের কর্মী-কলাকুশলী ও শিল্পীদের কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন তাদের রুজি-রুটির সংগ্রামে পাশে থাকার জন্য এই পর্যায়ে তিনি অভিনয় করেছিলেন 'মায়ামৃগ', 'কথা কও', 'স্বীকৃতি', 'নাম বিভ্রাট', 'অতয়েব', 'নহবত', 'সেমসাইড', 'আমি মন্ত্রী হবো', 'তথাস্তু', 'সুবর্ণগোলক' প্রভৃতি নাটকে অগস্ট ১৯৭৭-এ জহর রায় প্রয়াত হলেন ১৯৭৮-এ দেবনারায়ণ গুপ্তর অনুরোধে এলেন রঙ্গনা, অভিনয় করলেন চন্দ্রনাথজয়মা কালী বোর্ডিং’-এ পূর্ববঙ্গীয় বাকভঙ্গিমায় কৌতুকাভিনয় এই নাটকেই নাট্যসম্রাজ্ঞীর শেষ অভিনয় ১৯৭০-এ নাট্যশিল্পে অনন্য অবদানের জন্য সঙ্গীত নাটক আকাদেমি সম্মানে ভূষিতা হন নাট্যসম্রাজ্ঞী
    ১৯৭৯-র পরে আর অভিনয় করেননি সমসাময়িক অভিনেতা অভিনেত্রীরা সকলেই প্রয়াত হয়েছেন অথবা বয়সের ভারে ক্লান্ত হয়ে থিয়েটার থেকে সরে গেছেন প্রভা দেবী চলে গেলেন নভেম্বর ১৯৫২=তে ছবি বিশ্বাস ১৯৬২অহীন্দ্র চৌধুরী ১৯৭৪এ১৯৬৯-এ চলে গেলেন জহর গাঙ্গুলী গিরিশ ও শিশির যুগের সন্ধিক্ষণে উঠে আসা সরযূবালা নাট্যসম্রাজ্ঞী হয়ে একা ব্যবসায়িক থিয়েটারের অন্তিম লগ্ন ১৯৭৯ পর্যন্ত অভিনয় করে গিয়েছেন ২২শে জুলাই ১৯৯৪ বিরাশি বছর বয়সে চির বিদায় নিলেন নাট্যসম্রাজ্ঞী সরযুবালাথিয়েটারের মানুষজনের সরযূ মা
---
ছবি ও লেখার জন্য কৃতজ্ঞতা: রংরুট
নাট্যসম্রাজ্ঞী সরযুবালাথিয়েটারের মানুষজনের সরযূ মা



2 comments:

  1. এক কিংবদন্তি অভিনেত্রী সরজুমায়ের জীবন দলিল!!

    ReplyDelete
  2. রবি রায়ের কাছে কৃতজ্ঞ সরজু মায়ের জীবন তথ্য প্রকাশ করার জন্য-----
    নৃপেন সমাদ্দার

    ReplyDelete